আমার আব্বা একজন স্বৈরশাসক! তিনি যা বলতেন পরিবারে তার কথাই আইন ! ব্যক্তি স্বাধীনতা বা বাক স্বাধীনতা এসব পোশাকী শব্দ তিনি সেমিনার বা মিটিং এ ব্যবহার করতেন! পরিবারে এসবের বালাই ছিলো না!
কোন যৌক্তিক বা আবেগী আলোচনা তাকে টলাতে পারতো না - কারন তিনি আলোচনার সুযোগই দিতেন না ! বাজখাই গলায় পিলে চমকানো মুখভংগি করে হুংকার দিয়ে উঠতেন - চুউউউপ!
সূর্যের চেয়ে বালি বেশি গরম হয়- আমার আম্মাও আব্বাজানের সহবতে আরও বড় স্বৈরশাসক হয়ে উঠলেন !
মানুষ তার জীবদ্দশায় অনেক দু:সহ পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ম ওঠে কিন্তু স্বৈরশাসনে প্রায় কখনই অভ্যস্ত হতে পারেনা ! একটা সময় সে বিদ্রোহ করে!
আমার বিদ্রোহ তো দূর প্রতিবাদের দু:সাহসও ছিলনা তবে, মনে মনে বিপুলভাবে ক্ষোভ পুষে রাখতাম ! শুধু ভাবতাম, কবে বড় হবো ? আমি এতটাই আবাল ছিলাম যে, এটা বুঝতে পারিনি, সন্তান যতই বড় হোক, বাবা মায়ের চেয়ে বড় কখনও হতে পারে না!
পুঞ্জিভূত ক্ষোভ পরবর্তীতে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বে রূপ নেয়- যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে দূরত্বে!
যখন কার্ডিয়াক সার্জন হলাম- আমেরিকা কানাডা থেকে রিসার্চ পেপার প্রেজেন্টেশনের জন্য আমাকে ডাকে, টিভি চ্যানেলগুলোতে সাস্থ্য বিষয়ক টক শোতে আমন্ত্রণ জানায় - সেই পিনিকে আমি ভাবি,”মুই কি হনু রে”!
বাপ পোস্ট গ্রাজুয়েশন করা- আমিও, সেও ক্যডার সার্ভিস-আমিও! এই পিনিকে দূরত্ব জমে ঘন হয় !
এই যোজন যোজনের দূরত্ব এক লহমায় ঘুচে গেল যখন আমি কারাগারে গেলাম !
বৈবাহিক সম্পর্ক তো আগেই ডুবেছে। ও মা গো-বন্ধু, সহকর্মী, সহমর্মি, সহপাঠী এক ঝটকায় গায়েব ! কোথাও কেউ নেই !
শুধু আছেন বাবা মা ! তিন বছরে আমি তিলে তিলে উপলব্ধি করলাম, আমি বিগত সময় কতটা নিরেট গবেট ছিলাম। বাবা মা কে সময় না দিয়ে কত কাজে অকাজে ব্যতিব্যস্ত ছিলাম !
আর কি কখনও তাদের কাছে পাব !? তাদের কি জীবিত দেখার সুযোগ হবে ?
কারাগারের শীতল পাথুরে মেঝেতে সেজদায় কপাল ঠেকিয়ে দিনরাত একই প্রার্থনা করেছি, হে আল্লাহ! সংসার, সন্মান, চাকরি কিছুই ফেরত চাইনা- শুধু বাবা মায়ের সেবা করার সুযোগ দাও!
জানি, আমার সেবার বিন্দুমাত্র দরকার নেই তাদের কিন্তু আমার যে বড় প্রয়োজন এই ভুল শুধরে নেবার !
জেলখানার লৌহকপাট থেকে মুক্তির চেয়েও বেশি জরুরি তাদের যে আমি ভুল বুঝেছিলাম সেই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি!