ড্রাইভারের বিরক্তি উপেক্ষা করে মেয়েটিকে তিনি হুঁশিয়ারি করে গাড়িতে উঠতে বললেন। ঠিকানা শুনে রহমতের মুখ আরও কালো হয়ে গেল। গুলশান, বনানী বা ধানমন্ডির রাস্তায় বড় গাড়ি চালানো বেশ আরাম — সেসব জায়গায় সবাই সসম্ভ্রমে সাইড দেয়। যেটুকু যানজট হয়, মাঝেমাঝে রং সাইড দিলেও কেউ সাহস করে প্রতিবাদ করে না। এসব গাড়ি কথা-কথায় সার্জেন্ট দাঁড় করালেও জরিমানার সুযোগ পায় না; কারণ দামী গাড়ির কাগজপত্র সাধারণত ঠিক থাকে, চালকের লাইসেন্সেও গড়বড় থাকে না। থাকলেও—গাড়ি আটকে লাভ নেই; উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের একটি ফোনে সব চলে যায়। দামী মানুষের মাথার উপর দামী ছাতা থাকে!
পুরান ঢাকার গলিপথে বড় গাড়ি চালিয়ে হেডম দেখানোর জো নেই। রিকশার আঁচড় আর পথচারীর টেক্কা এড়িয়ে সাবধানে চালাতে হয়। রিকশা ঘষে গেলেও কিচ্ছু বলা যায় না; প্রতিবাদ করলে উল্টো তারা গালাগালি করে চেপে বসে: “এই তোর মায়েরে…!” সেইসব গলিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গজ কাপড়ের বস্তা বহনকারী রিকশাভ্যানের পিছনে বসে থাকতে হয়; নাক জ্বালানো কেমিক্যালের ঝাঁঝালো গন্ধ আর ভেতরে ঢুকা এসির ঠাণ্ডা—সব মিশে এক দুর্বিষহ অনুভূতি তেড়ে আসে। লোকজন পান চিবিয়ে পানের পিক ফেলে দিলে পিক ছিটে গাড়ির গায়ে লাগে; তা ঘষে উঠাতে মেজাজ গরম হয়ে ওঠে। কিন্তু স্যারের হুকুম হলে কী আর করা যায়? রহমত মুখ ভোঁতা করে গাড়ি চালায়।
ধনী家的 ম্যানেজার, ড্রাইভার বা গৃহকর্মীরা সাহায্যপ্রার্থীদের ওপর অমনোযোগী; পারতপক্ষে তাঁরা এসব লোককে স্যারের কাছে ঘেঁষতেই দিতে চান না। পরিশ্রম করে তারা টাকা নেয়, আর এই উকুন-ধাঁচের বেদিবাসীরা ইনিয়ে-বিনিয়ে হাজারটা বাহানা করে কিছু টাকা হাতিয়ে নিয়ে চলে যায়।
রহমতও এসব আজাইরা লোকের ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত। গত বারো বছর ধরে সে এই স্যারের ডিউটিতে আছে। বাবা ছিলেন এই বাড়িরই বাগানের মালী; সার্ভেন্ট কোয়ার্টারেই বড় হয়েছে সে। এতবছর দেখেছে—কত মানুষ স্যারের দরজায় ধরণা দেয়; কারো মেয়ের বিয়ে, কারো ছেলের চাকরি, কারো তিন মাসের বাড়িভাড়া বাকি, কারো ভাই মালয়েশিয়ার লেবার ভিসার জন্য দুই লাখ টাকা চাইছে—সবই অনবরত। বেগম সাহেবার মৃত্যুর পর থেকে স্যারের চারপাশে মানুষের আনাগোনা আরও বেড়েছে; রহমতের বিরক্তি বাড়ছে প্রতিদিন।
এই মেয়েটা—মুখে সোনার পাউডার মেখে আছে ঠিকই, কিন্তু গায় থেকে কাংগাল গন্ধ মুছে যায়নি। রহমত ভেবে বসে, না জানি কোন ধান্দার করে এ মেয়েটি স্যারের কাছে এসেছে। মনটা খিটখিটে; শ্বশর শব্দে কিছু একটা ঠিক নয় বোধ হচ্ছে।
(চলবে…)