অধিকাংশ সময়ে আমাদের মনোকষ্টের সবচেয়ে বড় কারণ হলো আমাদের জানা আর মানার মধ্যে বিশাল ব্যবধান ! অনেক কিছু আমাদের মস্তিষ্ক জানে কিন্তু আমাদের অন্তর মেনে নিতে পারেনা!
আমার বাবা যেদিন সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করলেন সেদিন তার চেহারায় এক অদ্ভুত অবসন্ন বিষাদ দেখেছি! এই সসন্মান আনুষ্ঠানিক প্রস্থানের নেপথ্যে একটি অস্ফুট বাক্য আছে- “আপনি যতই যোগ্য আর অভিজ্ঞ হন না কেন , আপনি এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আর পালন করতে পারবেন না! আপনি বুড়ো হয়ে গেছেন!”
প্রতিটি ক্যডার সার্ভিসে নিয়োগ প্রাপ্ত অফিসার মাত্রই জানেন,কবে তিনি অবসরে যাবেন-তারপরও মেনে নিতে পারেন না!
আমার মা যেদিন জানতে পারলেন, তিনি ডায়াবেটিসে ভুগছেন এবং রক্তে চিনির পরিমাণ এতই বেশি যে মিষ্টি খাওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ সেদিন কেমন হতবিহ্বল হয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে ছিলেন! চমচমের দেশের মানুষ এখন তিনবেলা চমচমের বদলে ঔষধ খান! আজীবন খেয়ে যেতে হবে!
ঢাকা মেডিকেল কলেজে সার্জারিতে ভর্তি আটাশ বছরের ছেলেটিকে যখন জানানো হলো সে কোলন ক্যানসারে ভুগছে সে অবিশ্বাস নিয়ে অপলকে তাকিয়ে ছিল ! তার সেই যন্ত্রণাকাতর মুখে আর্ত আবেদন আরও ভালো কো্ন সেন্টার থেকে হিস্টোপ্যাথলোজি রিপোর্ট করান ! তার সামনে দেশের দুটি সেরা ল্যাব থেকে করানো রিপোর্টে! কিন্তু সে কিছুতেই মানতে পারছেনা! মৃত্যুর দুদিন আগেও কী ভীষণভাবে সে বাঁচতে চেয়েছিল!
রেজিস্ট্রি ডাকে যেদিন তালাকের কাগজ এসেছে কী যে অপরিচিত লাগছিল সবকিছু! তালাক- সেটা কেমন শব্দ! আজ থেকে আড়ং এর বিছানার চাদরটা, বেলজিয়ান আয়নাটা, কাঁসার প্লেট টা, লোহার কড়াই টা কোনটাই নাকি আর আমার না! এও কি কখনো সত্যি হতে পারে ! না, না - মানি না! কেমনে মানব?
মাইলস্টোন স্কুলের সেই ছোট্ট বাচ্চার দগ্ধ শরীর- পৃথিবী ধ্বংস হোক - তারপরও মানতে পারবে না তার মা !
মানুষ প্রথম যেদিন কানের পাশে পাকা চুল দেখে কি অপার বিস্ময়ে সে বারবার আয়না দেখে !!! চোখের কোনের চামড়ায় ভেসে উঠেছে চিকন কুঁচি ! ঘন্টা বেজে গেছে ! মৃত্যু অমোঘ- সুনিশ্চিত! তারপরও মানতে কষ্ট!
ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল থেকে শুরু করে নির্বাচনের ফলাফল- মানতে অনেকসময়ই কষ্ট হয় ! কিন্তু মানতে হয় !
মনেরে তাই কহ যে
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে !
কলমে: ডাক্তার সাবরিনা।