ক্ষুধা এমন এক অবাধ্য, অসহ্য ,অসভ্য অনুভূতি যা প্রথমে তো পেটে শুরু হয় - এরপর মগজের প্রতি কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ে! একসময় বাড়তে বাড়তে সব চেতনাকে আচ্ছন্ন করে দেয় ! তখন পরিবেশ, পরিস্থিতি , দুশ্চিন্তা সব ছাপিয়ে একটাই চিন্তা- ক্ষুধা পাইসে- ক্ষুধা!
হাজতঘরে বসে আছি ! কোর্টে তোলা হবে দুপুর তিনটায় !আদালতে হাজিরার দিনে ভোর পাঁচটায় কাশিমপুর থেকে প্রিজন ভ্যান ছাড়ে! তখন মাত্র ফজরের আযান হয়েছে ! কাশিমপুরের কাঁঠাল আর চালতা গাছে তখনও থোকা থোকা অন্ধকার ঝুলে আছে! কাশিমপুরের বিখ্যাত মশা বাহিনী তখনও প্রবল প্রতাপে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে! বন্দিনীদের এক এক করে মাথা গুনে প্রিজন ভ্যনে তোলা হচ্ছে!
কাশিমপুর থেকে সদরঘাট- পথ শেষই হতে চায়না! বেলা দশটা থেকেই চনচন করে ওঠে ক্ষিধে! পানির বোতল থেকে দু এক ঢোক গলায় ঢালি - ক্ষিধে কমেনা - বরং বাড়ে!
হাজতঘরে বন্দিনীদের শোরগোল! কারও কারও আত্নীয়পরিবার খাবার নিয়ে এসেছেন ! হাজতঘরে বাইরের খাবার ঢোকানো নিষিদ্ধ! কিন্তু টাকা দিয়ে সব সম্ভব! যাদের খাবার এসেছে তারা গোগ্রাসে খাচ্ছেন ! কতদিন পর বাসার খাবার ! সামান্য পটলভাজি, কচুর ঘাঁটি অমৃত!
আমার বাসা থেকে খাবার আনার কেউ নাই! আব্বাকে এখানে টেনে আনতে নির্মমতা মনে হয়! আম্মা আর একমাত্র বোন আমেরিকায়! কে আসবে!?
খাবারের গন্ধে লোভ হয় ! কিন্তু ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকতে হয় - কেউ সাধলেও ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাথা নেড়ে ‘না’বলতে হয় ! ভদ্রতার মুখোশ বড়ো কিমভূতকিমাকার- উচিত কথা বলতে আটকায়, উচিত কাজ করতে আটকায়!
যারা এলিট শ্রেণীর বন্দিনী -দুদক, অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং এর মামলায় এসেছেন তারা খাবারের বাক্স নিয়ে পেছন ঘুরে বসে সাবাড় করতেন !
যারা মাদক, চুরি, গাঁজা এসব মামলার বন্দিনী আপাত দৃষ্টিতে “ফকিন্নি”তারা এত বড় বড় নলা বানিয়ে ভাত মুখে দিতেন ! তাদের মধ্যেই কেউ কেউ প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও চ্যাপা শুটকির সাথে মোটা চালের ভাত মাখিয়ে ইয়া বড় নলা আমার মুখে ঠুসে দিতেন !
চোখে পানি আসতো ! ওরা ভাবতো ঝালের চোটে - আমি শুধু জানতাম - কৃতজ্ঞতায় ! ক্ষুধা মুক্তির প্রমত্ত উল্লাসে !!!
ক্ষুধা কত নিষ্ঠুর, নির্লজ্জ - আমার মতো ক’জন বোঝে?!
আমার জ্বর শুনে আমার অনেক নারী ভক্ত নানারকম ফল, সজনে পাতা, হরেক রকম ভর্তা, রান্না খাবার নিয়ে ছুটে আসছেন ! তারা কেউ আত্মীয় নন, বন্ধু নন,কলিগ নন! তারা আমার লেখার ভক্ত!
আজ পেটের ক্ষুধা,মনের ক্ষুধা দুইই মিটে গেছে !